Sunday, June 10, 2018

বাড়ি - ১



একটা বাড়ির জন্য মানুষের ভালোবাসা কেন জন্মায়? মায়া তৈরী হয় কেনো?
আমাদের এই প্রথম বাড়ির জন্য আমার মায়া অনেক। এমনই অনেক যে বাড়ি পরিবর্তনের সময় বাড়িটা ছেড়ে যেতে মন চাইছিলো না। বাড়ি হিসেবে তেমন আহামরি কিছু না - বরং এর অনেক কিছুই আমার দৃষ্টিতে সৌন্দর্যবিমুখ। কিন্তু  এখানে এক দশকের অনেক মমতামাখানো স্মৃতি রচনা হয়েছে।

১০ বছর আগে অন্য আরেকটি বাড়ি কিনবো বলে যখন মনস্থির করেছি এবং লোনের কাগজপত্র তৈরী করছি তখন এই বাড়িটি মার্কেটে এলো। আমার নিকটের দশ বারোজন বন্ধু বান্ধব ডেকে দেখানো এবং সবার সাথে কথা বলে মন পরিবর্তন করা এবং অবশেষে অন্য বাড়ি বাদ দিয়ে এই বাড়ি কেনা। বাড়ি কেনার আগে শুধু বাড়ী দেখানো নিয়ে আমাদের ঘন্টা দুই-একের সেই আড্ডা - ব্যপারটা অদ্ভুত, বিচিত্র - কিন্তু স্মৃতিময়। সেই থেকে শুরু আনন্দ-বেদনার স্মৃতি।

বাড়ি কেনার সময় আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছিল প্রথম সন্তানের জন্মের জন্য। মুলতঃ স্ত্রীর জেদেই কেনা এই বাড়ি - বাঙালী জেদ - আর সবার বাড়ি আছে, আমাদের নাই কেনো? জেদের কাছে সচ্ছলতার হার-মানা। সন্তানের জন্ম-পূর্ব মাসগুলো কেটেছিলো সেই অসচ্ছলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আসবাব দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে তোলায়। একই সময় স্ত্রীর প্ররোচনায় গড়ে উঠলো বাড়ির ফুলের বাগান। আর এসব নিয়ে হাসি-আনন্দ-ঝগড়া-তর্ক নিয়ে গড়া অফুরন্ত স্মৃতি।

এই বাড়িটিতে ওঠার কিছুদিনের মধ্যেই জন্ম হলো আমার কন্যা - অহনা-র। তারও কিছু বছর পরে জন্ম আমার পুত্র - আনিক-এর। আনিক আর অহনার সব 'প্রথম'ই রচনা এই ঠিকানায় - হামাগুড়ি, প্রথম বুলি, পদচারনা, দৌড়, সাইকেল, হাসি-কান্না-অভিমান, জন্মদিন, স্কুল, সংগীত - আরো কত কিছু। এ বাড়ির উঠোন - লু-হাওয়া, ঝোড়ো বাতার, মুষল বৃষ্টি, শিলা, তুষার উপভোগ করার জন্য খবই উপযুক্ত। একবার শীতে তুষারপাত হলো - উঠোনে আমি আর অহনা তৈরী করলাম মিনি-স্নো-ম্যান - হাটু সাইজ। আর একবার বর্ষায় বড় বড় শিলায় ছেয়ে গেলো পেছনের উঠোন। অহনা অবাক চোখে সেই শিলাপাত দেখলো - হাতে তুলে নিলো বরফ - সে কি আনন্দ তার মুখে-চোখে। এসব নিয়ে অহনা যতটা উৎসুক, আনিক ঠিক ততটাই উদাসীন। আনিকের কাছে এ বাড়ির আনাচে কানাচে নীরবে একা একা বই পড়া, ট্যাবলেট দেখা অথবা ঘাপটি মেরে থাকা বেশী উপভোগ্য ছিল। মাঝে মাঝে রাতে যখন আমি দোতলার গেইম রুমে কম্পিউটারের সামনে থাকতাম, আনিক এসে 'আমি টায়ার্ড' বলে চুপচাপ বসে পরতো আমার কোলে -  এবং খুব শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়তো।

আমার বাবা-মারও অনেক স্মৃতি রচনা হলো এ বাড়িতে। বাড়ীর সামনে আর পেছনের উঠোনে তেমন কোনো গাছপালা নেই বলে আমার মা টেক্সাসের গ্রীষ্মের খররোদ উপেক্ষা করে একবার সাজিয়ে তুললো ফল এবং সব্জী বাগান। রেডিওতে বলছে সবাইকে যথাসম্ভব এই তীব্র গরমে বাড়ীর ভেতরে থাকতে এবং ডিহাইড্রেশন থেকে সাবধান হতে । আর অফিস থেকে বাড়ীতে এসে দেখতাম তিনি বাগানে সেই রোদেই কাজ করে চলেছেন। আমাদের বাকী সবার কটাক্ষ উপেক্ষা করে গড়া সেই বাগানের সব্জী এবং ফল হলো - লাউ, বরবটি, সিম, ঢেরস, পিচ, নাসপাতি, ডালিম। তার অনেক কিছুই তিনি দেখলেন দেশে ফিরে গিয়ে স্কাইপে। বাড়ির সামনে দুটো বামুন-ম্যগনোলিয়া - আমার মা-র পছন্দের। এতই পছন্দের যে বর্ষাকালে কোথাও নিমন্ত্রন থাকলে, তিনি একটা করে ম্যাগনোলিয়া নিয়ে যেতেন উপহার হিসেবে।

এ বাড়িতে ওঠার কিছুদিন পরে যখন আমার কনিষ্ঠা তার পরিবার নিয়ে চলে এলো একই শহরে, তখন এ বাড়িটার দুটো বাড়ি পরেই তারা পেয়ে গেলো আরেকটি বাড়ি। আমার বাবা-মার জন্য এটা ছিল বারতি উপহার। পাশাপাশি বাড়ি - যখন তখন এ বাড়ি ও বাড়ি - তাঁদের অত্যন্ত প্রিয় কাজ। আর আমার ছেলে-মেয়ের জন্য এটা ছিল হয়ত তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। ভাই-বোন যখন তখন ফুপুর বাড়ি ফুপাতো ভাই-বোনের সঙ্গে সময় কাটাতে যেতো। অহনা তার ফুপুর বাড়ি গেলে প্রতিবারই ফেরত আসতে চায় না - প্রতিবারই কান্নাকাটি যেন আর কোনোদিন আসা হবে না। এ বছর বিগত কয়েক মাস সে বাড়িতে প্রধান আকর্ষন তাদের ফুপা আর ফুপাতো ভাই-বোনের পোষা চারটি হাঁসের ছানা - যারা এখন আর ছানা নেই। পাশাপাশি বাড়ি বলেই সেই ছানাগুলোর বড় হওয়া তারা দেখেছে গ্রীষ্মের ছুটিতে।

এরকম আরো সহস্র স্মৃতির মূল্যে গড়া এই বাড়ি এক দশক পরে ছেড়ে যেতে কার ভালো লাগে? বাড়ি শুধু বাড়ি নয় - আমাদের অতীতের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।


No comments:

Post a Comment